প্রিয় শিক্ষার্থী, আসসালামু আলাইকুম।
আজকে আমি কথা বলবো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ বলাকা নিয়ে। আমরা জানি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সর্বমোট ৫৬টি কাব্য রচনা করেন। তার মধ্যে অন্যতম হলো আজকের আলোচনার বলাকা কাব্যটি। সৃষ্টির গতিতত্ত্ব, বিশ্বজগতের মধ্যে চিরন্তন বেগের রহস্য এই কাব্যে পরিলক্ষিত হয়। শুরুতে বলতে চাই বলাকা শব্দের অর্থ বক জাতীয় পাখি বা উড়ন্ত বকের সারি। বলাকা কাব্যটি ১৯১৬ সালে প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বলাকা কাব্যটি এতো বেশি গুরুত্ব বহন করে যে এটি রবীন্দ্রনাথের কাব্য রচনার "বলাকা পর্ব" নামে উল্লেখ করা হয়। আর বলাকাই হলো এ পর্বের উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই কাব্যটি তাঁর প্রিয়পাত্র উইলিয়াম পিয়ারসন বন্ধুবরেষুকে উৎসর্গ করেন। এই কাব্যের মধ্যে মোট ৪৫টি কবিতা আছে। এ কাব্যের ১ম কবিতার নাম হলো- সবুজের অভিজান (১ সংখ্যক কবিতা) এবং শেষ কবিতা হলো-নববর্ষের আর্শীবাদ (৪৫ সংখ্যক কবিতা) । বলাকা কাব্যের মূল সুর হলো- গতিবাদ বা গতিতত্ব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ কাব্যের বেশির ভাগ কবিতা রচনা করেন সবুজ পত্র পত্রিকায় ছাপানোর জন্য। বলাকাতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক বার্গসঁ এর গতিবাদের সাথে তুলমামূলক আলোচনা করেন। এছাড়াও বলতে পারি বলাকা কাব্যের বেশির ভাগ কবিতাই মুক্তক ছন্দে রচিত।
শুধু ধাও, শুধু ধাও, শুধু বেগে ধাও
উদ্দাম উধাও;
ফিরে নাহি চাও,
যা কিছু তোমার সব দুই হাতে ফেলে ফেলে যাও।
বলাকা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গতিচেতনা বিষয়ক বা গতিতত্ত্বমূলক কাব্য। অতীতের অবিরত প্রবাহ নিরবচ্ছিন্নভাবে ভবিষ্যতের গর্ভে প্রবেশ করছে। বর্তমান সেই চলমান অতীত ভবিষ্যতের মধ্যে একটি হাইফেন মাত্র। বর্তমান বলে কিছুই নেই। কারণ যে মুহূর্তকে আমরা বর্তমান বলি, তৎক্ষণাৎ তা অতীত হয়ে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যৎ এসে সেই বর্তমান নামক কাল বিন্দুর স্থান অধিকার করে- আর এসব কিছু ঘটে গতিবেগের কারণে। সৃষ্টির আদিতে আছে এক অফুরন্ত গতিবেগ। এই গতিবেগের বলেই গাছ-পালা, তরু-লতা পাখা মেলে শূন্যে উড়ে যেতে চায়। পর্বতরাজি বৈশাখের মেঘের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে গতিবেগের সাথে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে চায়। এই চলমান গতিপ্রবাহের মধ্যেই জীবনের চরম সত্য লুকায়িত। এই পরিবর্তনে বাধা দিলে সবখানে দেখা দেয় জড়ত্ব এবং পঙ্গুত্ব- আর তার ফলাফল হিসেবে অনিবার্য মৃত্যু। সুতরাং সময়ে এই চলমান প্রবাহকেই আমরা গতি বলি এবং তার তত্ত্বই গতিবাদ। আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'বলাকা' কাব্যে ফরাসি দার্শনিক Bergson এর মতবাদ গতিতত্ত্বের প্রভাব লক্ষ করি।
বলাকা কাব্যগ্রন্থের উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলি হলঃ ১। সবুজের অভিযান, ২। শঙ্খ, ৩। ছবি, ৪। শা-জাহান, ৫। বলাকা।
১। সবুজের অভিযান (১ সংখ্যক কবিতা)
'ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা,
ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ,
আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’-
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নবীনদের প্রতি কোনো বিশেষ কাজ সম্পাদনের শুরু করার প্রত্যয় চেয়ে আহ্বান করেছেন। এখানে তিনি নবীনদের ডাকছেন অর্ধমৃত, জরাগ্রস্তদের আঘাত করে জাগিয়ে তুলতে। কবির ভাষায় নবীনরা অশান্ত, দুরন্ত, প্রমত্ত, প্রচন্ড, চিরজীবী এবং অমর। যুগে যুগে নবীনদের হাত ধরেই সমাজ, সভ্যতা কিংবা সংস্কৃতি এগিয়ে গেছে। তাই জড়ার্জিণ ব্যক্তিসত্ত্বাকে ভেঙে ফেলে তারুণ্য মুখর পৃথিবী সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছেন এ কবিতার মাধ্যমে।
বলাকা কাব্যগ্রন্থের উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলি হলঃ ১। সবুজের অভিযান, ২। শঙ্খ, ৩। ছবি, ৪। শা-জাহান, ৫। বলাকা।
২। শঙ্খ (৪ সংখ্যক কবিতা)
তোমার কাছে আরাম চেয়ে
পেলাম শুধু লজ্জা।
এবার সকল অঙ্গ ছেয়ে
পরাও রণসজ্জা।
শঙ্খ কবিতায় নবযুগকে আহ্বান করার জন্য কবি শঙ্খ বাজানোর পক্ষপাতী। তাঁর মনে হয়েছে মানুষকে মিলিত করার, নবযুগকে আহ্বান করার শঙ্খ জন্য বাজাতে হবে। শঙ্খের আহ্বান যাদের কানে পৌছেছে তারা বুঝতে পারছে অরুণোদয়ের আভাস। নতুন যুগকে তারা অন্তর্দৃষ্টিতে দেখছে। এখানে কবিসত্তা চেয়েছে পুঞ্জীভূত সামাজিক পাপের অবসান, সাম্রাজ্যবাদের পতন। কবি চেয়েছেন জাতি-বর্ণবিভেদে কলুষিত এদেশ থেকে অমানবীয়তার বিদায়; চেয়েছেন নিপীড়িত সংগ্রামী মানুষের বিজয়। তাই 'শঙ্খ' কবিতায় সংগ্রামী আবেদনের সঙ্গে স্বদেশের সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার আহ্বানও স্বাভাবিক ভাবেই যুক্ত হয়েছে। কবির হৃদয়ের বক্তব্য এখানে সুস্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে।
বলাকা কাব্যগ্রন্থের উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলি হলঃ ১। সবুজের অভিযান, ২। শঙ্খ, ৩। ছবি, ৪। শা-জাহান, ৫। বলাকা।
৩। ছবি (৬ সংখ্যক কবিতা)
"নয়নসম্মুখে তুমি নাই,
নয়নের মাঝে নিয়েছ যে ঠাঁই।"-
"বলাকা" কাব্যের 'ছবি' কবিতার প্রদত্ত চরণদ্বয়ের মাধ্যমে কবি তাঁর স্ত্রীকে কীভাবে অন্তরের মধ্যে স্থান দিয়েছেন তা ফুটিয়ে তুলেছেন। সৃষ্টির কোন কিছুই স্থির নয়। বিশ্বের প্রতিটি বস্তুই অনন্তকালের মাঝে নব নব রূপে আত্মপ্রকাশ করছে ধ্বংসের মধ্য দিয়ে। সব কিছুই ছুটে চলছে অনন্তের অভিসারে। জীবিতকালে কবির যাত্রাপথের প্রধান সাথী ছিলেন তিনি। কবির জীবনে তিনি ছিলেন সত্য এবং সবকিছুরই প্রেরণাদাত্রী। তাঁর মাধুর্যের মধ্য দিয়ে কবি বিশ্বকে সুন্দর ও রসময় হিসেবে দেখেছিলেন। তিনিই বিশ্বের আনন্দের বার্তাকে কবির কাছে মূর্তিমতী বাণীরূপে নিয়ে এসেছিলেন। দুজন একসাথে চললেও কবি-পত্নীর মৃত্যুতে কবির সে-যাত্রা থেমে গেছে। তাই কবি-পত্নীর ছবি কবির কাছে অচল মাত্র নয়- একটি বেগবান প্রেরণাশক্তি।
বলাকা কাব্যগ্রন্থের উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলি হলঃ ১। সবুজের অভিযান, ২। শঙ্খ, ৩। ছবি, ৪। শা-জাহান, ৫। বলাকা।
৪। শা-জাহান (৭ সংখ্যক কবিতা)
এড়াইয়া কালের প্রহরী
চলিয়াছে বাক্যহারা এই বার্তা নিয়া---
ভুলি নাই, ভুলি নাই, ভুলি নাই প্রিয়া!’