জনতার সংগ্রাম চলবেই চলবে | শেখ লুতফর রহমান স্মরণ | গণসংগীত | মুক্তিসংগ্রাম | সিকান্দার আবু জাফর
ฝัง
- เผยแพร่เมื่อ 10 ม.ค. 2025
- (ধারণকৃত ভিডিওটি জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠান ২০২১, যুক্তরাজ্য থেকে শেখ লুসি রহমান প্রদত্ত)
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বার্তা, নভেম্বর ২০২৪ সংখ্যায় প্রকাশিত
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামী গণসংগীত শিল্পীদের কাছে যিনি গণসংগীত সম্রাট অভিধাপ্রাপ্ত হয়ে আছেন। শেখ লুতফর রহমান একজন কিংবদন্তীতুল্য সুরকার ও গীতিকার। জন্মেছেন ১৯২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বর্তমান সাতক্ষীরা জেলায় অবস্থিত সুলতানপুর গ্রামে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন কলকাতায় থাকা অবস্থায় তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন মানব ইতিহাসের ভয়াবহতম ১৯৪৩ এর মনন্তর। চল্লিশের দশকের সেই সময়টাতে ঘটে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা আইপিটিএ-এর সাথে সম্পৃক্ততা। তরুণ চোখে প্রত্যক্ষ করেছেন সাতচ্চল্লিশের দেশভাগ পূর্বাপর ভয়াবহ দাঙ্গা। এসময় তিনি কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে নিজেকে নিবেদন করেন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামী সাংস্কৃতিক সংগ্রামে। তারপর গণসংগীতের রথে এক জীবনে অতিবাহিত করেছেন এক মহাকাব্যিক যাত্রা। এ সাংস্কৃতিক সংগ্রামযাত্রার সূচনা হয় ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের শুরুর পর্বে। মোহম্মদ আলী জিন্নাহ কর্তৃক উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার পর মাতৃভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে তিনি সুরারোপ করেন চারটি গণসংগীত- ‘ঘুম পাড়ানি গান আজি নয়’, ‘ওগো বৈশাখী ঝড়, ‘ওরে ভাইরে ভাই, বাংলাদেশে বাঙালি আর নাই’ গীতিকায় এবং কবি কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী বিদ্রোহী কবিতায়। এরমধ্যে প্রথমোক্ত গণসংগীত তিনটির গীতাকার অধ্যাপক আনিসুল হক চৌধুরী।
একই সময় তিনি মাতৃভাষায় অধিকার এবং পূর্ববাংলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিভিন্ন রাজনৈতিক জনসভায় এসব গণসংগীত গাইতে শুরু করেন। ১৯৫০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক জনসভায় তিনি গান গাওয়ার পর মাওলানা ভাষানীর তাঁকে জড়িয়ে ধরে ভাসানী বলেন- ‘ (জনতার উদ্দেশ্যে বলেন) শুধু এই ছেলে নয়, আগামী দিনের ভবিষ্যৎ যুবকদেরও গাইতে হবে এমন গান, জাগিয়ে তুলতে হবে দেশের মানুষকে। (পাকিস্তান শাসকদের উদ্দেশ্যে বলেন) এই শয়তানদের শয়তানী মোকাবেলা করতে হবে। (শেখ লুতফর রহমানের উদ্দেশ্যে বলেন) এসব গান শিখতে তোমার কাছে যাবে সবাই, তুমি সকল শিখাবে।’ একই বছর তিনি সুরারোপ করেন আল্লা ভাত দে কাপড় দে বাঁচতে দে রে তুই (কথা: আবদুল করিম) এবং হিংসায় গড়া আজিকার ধরা (কথা: আনিসুল হক চৌধুরী)। সেবার পূর্ববাংলায় আবারও ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আরম্ভ হলে তিনি সৃষ্টি করেন আরেক গণসংগীত প্রেমের পৃথিবী কার অভিশাপে হল আজ মরুময়। শেখ লুতফর রহমানকে ঘিরে মাওলা ভাসানীর প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটতে দেখা যায় পঞ্চশ ও ষাটের দশক জুড়ে।
১৯৫২ সালে অধ্যাপক আনিসুর রহমান রচিত ভাষা আন্দোলনের প্রথম গণসংগীত- শোনেন হুজুর, বাঘের জাত এই বাঙালেরা জান দিতে ডরায় না, তারা তাদের দাবি বাংলা ভাষা আদায় করে নেবে ভাই। এরপর ড. রফিকুল ইসলামের উদ্যোগে আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙা একুশে ফেব্রæয়ারি কবিতাকে গানে রূপান্তরের প্রচেষ্টায় তিনি প্রাথমিক সুরারোপ করেন, একই সাথে সুরস্রষ্টা আলতাফ মাহমুদও সুরারোপ করেন। তিনি এক অনুষ্ঠানে আলতাফ মাহমুদের সুরারোপিত গানটি শুনে মুগ্ধ হয়ে উপস্থিত শ্রোতা ও সংগীত শিল্পীদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা দেন- ‘এখন থেকে আলতাফ মাহমুদের সুরারোপিত গানটিই আমরা সকলে গাইবো।’ ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৪ সাল অব্দি ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কমিল্লায় অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনসমূহে তিনি নিজের সুরারোপিত গণসংগীত নিয়ে হাজির হয়েছেন প্রতিবার।
শেখ লুতফর রহমানের সুরারোপিত উল্লেখযোগ্য অন্যান্য গণসংগীত সমূহ হলো, মিলিত প্রাণের কলরবে- কথা: হাসান হাফিজুর রহমান (১৯৫৩), ওরে বিষম দৈরার ঢেউ- কথা: শহীদ সাবের (১৯৫৪), ওরে ও কৃষাণ দেখ না চেয়ে আসছে কারা- কথা: মোমিন (১৯৫৪), দিকে দিকে জাগি আজি বিপ্লব- কথা: মফিজউদ্দিন আহমদ (১৯৫৪), মেল আঁখি মেলরে, রাত পোহায় গেলোরে, বাছা আমার জাদু আমার ঘুমাও না (১৯৫৩-৫৫), জনতার সংগাম চলবে- কথা: সিকান্দার আবু জাফর (১৯৬৪), এই আগুন নিভাইবো কে রে (১৯৬৬-৬৯), বিপ্লবে রক্ত রাঙা ঝাণ্ডা ওড়ে আকাশে- কথা: আবু বকর সিদ্দিকী (১৯৬৯), ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য- কথা: সুভাষ মুখোপাধ্যায়, পায়রার পাখনা বারুদের বহ্নিতে জ্বলছে- কথা: আবু বকর সিদ্দিকী (১৯৬৯), হিমালয় থেকে সুন্দরবন- কথা: সুকান্ত আচার্য, নিপীড়িত দুনিয়াটা জাগছে, এগিয়ে চল এগিয়ে চল, হাতে তোদের সূর্য পতাকা এগিয়ে চল, আমরা তো উজ্জ্বল সূর্য ভোর করে যাই কাল রাত্রি (১৯৬৯/৭০)।
১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর সব রকমের সভা-সমাবেশ বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৫৯ সালে সামরিক শাসনের মধ্যে কার্জন হলে আয়োজিত একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে তিনি অংশ গ্রহণ করেন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবর্ষ উদযাপন হয় নানা বাধা নিষেধ উপেক্ষা করেই। এই বাধা নিষেধের বেড়াজালে গণসংগীত সৃষ্টিতেও কিছুটা ভাটা পরে তখন। ১৯৬৪ সালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্র নামক নির্বাচন পদ্ধতির সুত্রপাত করলে বাঙালিদের সমর্থিত ফাতেমা জিন্নাহ সেই প্রহসনের নির্বাচনে পরাজিত হন। সেসময় সমকাল পত্রিকার সম্পাদক কবি সিকান্দার আবু জাফরের জনতার সংগ্রাম চলবে শিরোনামে একটি উদ্দীপণামূলক কবিতা ইত্তেফাকের উপসম্পাদকীয় পাতায় ছাপা হলে, আরেক কিংবদন্তী সংস্কৃতিকর্মী কামাল লোহানী পত্রিকায় প্রকাশিত কবিতাটি শেখ লুতফর রহমানের কাছে নিয়ে যায় গণসংগীতের সুরারোপের উদ্দেশ্যে।
প্রথমে তিনি কবিতার কথাগুলো সুর সৃষ্টির জন্য কঠিন বলে অপারগতা প্রকাশ করেন। পরে কিছুটা গান উপযোগী সহজ শব্দে বদল করে নিয়ে কবিতাটিতে সুরারোপ করেন। এভাবেই জন্ম লাভ করে মুক্তিসংগ্রামের অমর গান জনতার সংগ্রাম চলবেই চলবে। গণসংহীতের সুর বিবেচনাতেও গানটি অনন্য অসাধারণ। পরবর্তীতে ১৯৬৯’র গণঅভ্যুত্থান মুক্তিকামী জনতাকে জাগাতে রাজপথে এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এই গান প্রচারিত হয়েছে অন্য অনেক গানের সাথে। ‘বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’ শরনার্থী শিবির এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গিয়ে গেয়ে বেড়িয়েছেন গণমানুষের মুক্তির আশা জাগানিয়া এই গুরুত্বপূর্ণ গণসংগীতটি। এই কালজয়ী গানের সুরকার শেখ লুতফর রহমান ১৯৯৪ সালের ৩০ নভেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
-শরীফ রেজা মাহমুদ